প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চল বিভিন্ন নিদর্শন বহন করে আসছে। বাংলাদেশের সর্ব-উত্তরের এই জেলাকে প্রচীন-বরেন্দ্র-অঞ্চল বলে মনে করেন ঐতিহাসিক ও ভূগোলবিদগণ। কারণ, এ অঞ্চলে বহু প্রাচীন পুরাকীর্তি ও প্রত্ন বস্তুর সন্ধান পাওয়া গেছে। এক সময় উত্তরবঙ্গের সিংহভাগ এলাকা পুন্ড্রবর্ধনের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই পুন্ড্রবর্ধনই পরবর্তীতে গৌড় নামে পরিচিত হয়। পর্যটক ইবনে বতুতার বিবরণী মতে, গৌড় শহর গঙ্গা-করতোয়া নদীদ্বয়ের মধ্যে কোনো এক স্থানে অবস্থিত ছিল। ঐতিহাসিক পন্ডিতগণ চাঁপাইনবাবগঞ্জকে গৌড়ের অংশ হিসেবে মনে করেন।

এ জেলার ৫টি উপজেলার মধ্যে ঐতিহাসিক নিদর্শন ও প্রতœসম্পদে সবচেয়ে সমৃদ্ধ শিবগঞ্জ উপজেলা। এ উপজেলার সোনামসজিদ অঞ্চল ছিল তৎকালীন গৌড়ের রাজধানী। বিভিন্ন ধরনের ঐতিহাসিক স্থাপনা ও দর্শনীয় নিদর্শন রয়েছে সেখানে। হিন্দু শাসনামলে সেন বংশের শেষ রাজাদের খননকৃত কয়েকটি দিঘী এবং সুলতানী আমলে মুসলিম সুলতানদের নির্মিত মসজিদসমূহই এ উপজেলার ইতিহাসকে করেছে সমৃদ্ধ। এছাড়াও বৃটিশ আমলে স্থানীয় জমিদারদের কিছু স্থাপনাও রয়েছে সেখানে। এসব ঐতিহ্য দেখার জন্য দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিনিয়ত পর্যটকগণ আসেন।

৪৩ চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ (শিবগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য ডা. সামিল উদ্দিন আহমেদ শিমুল বলেন, ‘এতদিন এ এলাকায় কোনো মানসম্মত আবাসিক, অনাবাসিক হোটেল বা রেস্টুরেন্ট ছিলনা। তাই বিভিন্ন সময়ে অনাকাঙ্খিত বিড়ম্বনার মুখোমুখি হয়ে অতৃপ্তি নিয়ে ফিরে গেছেন অনেক পর্যটক। এজন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সোনামসজিদে প্রায় সাড়ে ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করে দিয়েছেন একটি আধুনিক ও দৃষ্টিনন্দন পর্যটন মোটেল। সেখানে স্বল্প খরচে পাওয়া যাচ্ছে উন্নতমানের খাবার ও নিরাপদ-আরামদায়ক আবাসন। এটিই এ জেলার প্রথম এবং একমাত্র পর্যটন মোটেল। সোনামসজিদ জিরো পয়েন্টে ভারতে যাতায়াতের জন্য ইমিগ্রেশন ও বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম স্থলবন্দর অবস্থিত। এছাড়াও আশেপাশে বেশকিছু ঐতিহাসিক স্থাপনা থাকায় এখানে প্রতিদিনই পর্যটকগণ আসেন। পর্যটকদের অত্যাধুনিক ও উন্নত সেবা দিতেই বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার এখানে পর্যটন মোটেল নির্মাণ করেছে।’

সোনামসজিদ পর্যটন মোটেলের নির্বাহী অফিসার মনোয়ার ফেরদৌস খন্দকার জানান, গত ২৭ সেপ্টেম্বর মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এ মোটেলের আনুষ্ঠানিক উদ্ধোধনের কথা ছিল। অনিবার্য কারণে তা সম্ভব হয়নি। তবে আনুষ্ঠানিক উদ্ধোধন না হলেও এর সকল কার্যক্রম ইতিমধ্যে চালু করা হয়েছে। এখানে পর্যটকদের জন্য উন্নত আবাসন রয়েছে। স্থানীয় অন্যন্য হোটেলের চেয়ে খাবারের মান উন্নত ও স্বাস্থ্যসম্মত। তবে মূল্য সমপর্যায়ের। তিনি আরও জানান, তিন তলা বিশিষ্ঠ এই পর্যটন মোটেলে রয়েছে ১৮টি ভিআইপি কক্ষ, সাধারণ কক্ষ ১২টি, ইকোনমি কক্ষ ও সাধারণের জন্য ডরমিটরি কক্ষ ১২টি, অভ্যর্থনা কক্ষ ১টি, ক্যান্টিন ১টি, রান্নাঘর ১টি এবং ১টি বৈদুতিক সাবস্টেশ কক্ষ।

বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, প্রায় সাত কোটি টাকা ব্যয়ে মোটেলটি নির্মাণ করা হয়েছিল। নির্মাণকাজ সম্পন্ন করে, ২০১২ সালের ৩০ ডিসেম্বর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এটি পর্যটন করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করে। মোটেলটি চালু হওয়ার আগেই ২০১৩ সালে জামায়াত-বিএনপির নাশকতার আগুনে পুড়ে যায়। সাত বছর পর মোটেলটি এ বছর সংস্কার করা হয়েছে এবং অনানুষ্ঠানিকভাবে চালু করা হয়েছে।

জানা গেছে, পর্যটন মোটেলটি ২০১৩ সালের ৩ মার্চ উদ্বোধন হবার কথা ছিলো। কিন্তু মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায়ের দিন, অর্থাৎ ২৮ ফেব্রুয়ারী এই মোটেলে আগুন দেয় জামাত বিএনপির দুর্বৃত্তরা। ঐদিন ঘটনাস্থলে নিহত হন পর্যটন বিভাগের একজন নির্বাহী প্রকৌশলী। সেসময় মোটেলটি আর চালু করা সম্ভব হয়নি। ক্ষতিগ্রস্থ পর্যটন মোটেলটি সংস্কারের জন্য ২০১৫ সালে পর্যটন করপোরেশনের চেয়ারম্যানের কাছে পত্র দেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের তৎকালীন জেলা প্রশাসক মরহুম জাহিদুল ইসলাম। এর প্রায় ৫ বছর পর চলতি বছরে এটি সংস্কারের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দিয়েছে বেসামরিক ও পর্যটন মন্ত্রণালয়।

বাংলার তৎকালীন রাজধানী গৌড়ে বিপুল সম্ভবনা থাকলেও এতদিন সেখানে পর্যটকদের জন্য খাবার ও থাকার কোনো ব্যবস্থা ছিলনা। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার প্রথম মেয়াদে ক্ষমতায় এসেই শিবগঞ্জ উপজেলার পিরোজপুর মৌজায় একটি পর্যটন মোটেল নির্মাণের জন্য পর্যটন করপোরেশনের নামে এক একর জমি অধিগ্রহণ করেছিল। ২০১০-১১ অর্থবছরে সোনামসজিদে পর্যটন শিল্প বিকাশের জন্য অর্থ বরাদ্দ দিয়েছিল।

সোনামসজিদে পর্যটন মোটেল সংলগ্ন এলাকায় রয়েছে বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর ও বীব মুক্তিযোদ্ধা মেজর নাজমুল হকের সমাধি, মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের গণকবর, ঐতিহাসিক তোহাখানা মসজিদ, কামেল পীর হজরত শাহ নেয়ামতুল্লাহ (র.) এর মাজার, ঐতিহাসিক ছোট সোনামসজিদ, শাহ সুজার দৃষ্টিনন্দন কাচারি বাড়ি, দারসবাড়ি মসজিদ, কোতোয়াল দীঘি, টাকশাল দীঘি, বিশাল আয়তাকার বালিয়াদীঘি, দখল দরজা, চামাকাঠি মসজিদ, ধনাইচক মসজিদ, খঞ্জনদীঘি মসজিদ, কানসাট রাজবাড়ি সহ অসংখ্য পীর আউলিয়ার মাজার।

বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী নজরুল ইসলাম জানিয়েছেন, ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে সম্প্রতি মোটেলটি সংস্কার, আধুনিকায়ন ও দৃষ্টিনন্দন করা হয়েছে। ২০১৩ সালে নাশকতার আগুনে মোটেলের প্রায় সবকিছুই নষ্ট হয়ে গেছিলো। এগুলো পুনঃনির্মাণ করা হয়েছে এবং সকল ফার্নিচার ও আনুসঙ্গিক জিনিসপত্রও নতুনভাবে কেনা হয়েছে।

সোনামসজিদ পর্যটন মোটেল ভবনে রয়েছে ১২টি এসি রুম, ৬টি নন-এসি রুমে ৫০ আসন বিশিষ্ট একটি রেস্টুরেন্ট এবং ৫০ আসন বিশিষ্ট ডরমেটরি ও পার্কিং সুবিধা। এসি কাপল ও টুইন বেড রুম ভাড়া ২ হাজার টাকা, নন এসি টুইন বেড- ১৪ শো টাকা, ডরমেটরি প্রতি বেড ৩শো টাকা (এক রুমে চার বেড), ৪ বেডের পুরো রুম নিলে ভাড়া ১ হাজার টাকা।

Save Pdf

Not Found PDF File.